বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ: নতুন সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশে ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশ গত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব গতিতে এগিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন থেকে শুরু করে আজ দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে ডিজিটাল সেবা ও ব্যবসার প্রসার আরও বেগবান হয়েছে।

ফিনটেক খাতের উত্থান

বাংলাদেশে ফিনটেক (ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি) খাতের বিকাশ ডিজিটাল অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০টিরও বেশি ফিনটেক প্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট, ই-ওয়ালেট এবং অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিন দিন জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় এবং সুরেক্ষা-সহ বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আর্থিক সেবা পৌঁছে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে সক্রিয় অ্যাকাউন্ট রয়েছে প্রায় ৫ কোটি। প্রতিদিন গড়ে ৩,৫০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে।

ই-কমার্সের প্রসার

ডিজিটাল অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো ই-কমার্স। বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতের বার্ষিক বৃদ্ধি প্রায় ৪০ শতাংশ, যা বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল বাজার হিসেবে পরিচিত। দাপ্তরিক হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২,৫০০-এরও বেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।

ডাক বিভাগের 'ই-কমার্স ডেলিভারি সার্ভিস', 'পোস্ট ই-সেন্টার' এবং 'ডিজিটাল পোস্ট অফিস' প্রকল্পগুলো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ই-কমার্সের সাথে যুক্ত করতে সাহায্য করছে। এছাড়া, ফেসবুক-ভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসাও দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, যেখানে প্রায় ৩০,০০০ পেজ সক্রিয়ভাবে পণ্য বিক্রি করছে।

স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম

বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গত পাঁচ বছরে অভাবনীয় উন্নতি করেছে। বর্তমানে দেশে ১,২০০-এরও বেশি স্টার্টআপ রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো মোট ৩৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ সংগ্রহ করেছে।

শোভিড, পাঠাও, চালদাল, বাংলাকার, প্রযুক্তি-সহ বেশ কিছু স্টার্টআপ ইউনিকর্ন (১ বিলিয়ন ডলার মূল্যায়নের কোম্পানি) হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। সরকারের 'স্টার্টআপ বাংলাদেশ' উদ্যোগ এবং বিভিন্ন বেসরকারি এক্সিলারেটর প্রোগ্রাম নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

ডিজিটাল অর্থনীতির এই দ্রুত বিকাশের পথে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও। ডিজিটাল নিরাপত্তা, সাইবার অপরাধ, ডাটা প্রোটেকশন, ডিজিটাল দক্ষতার অভাব এবং আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এখনও উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।

সরকার ইতোমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ডাটা প্রোটেকশন আইন এবং ই-কমার্স গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। তবে এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং আপডেট করা প্রয়োজন। এছাড়া, ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি, ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লকচেইন, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এর ব্যবহার বাড়ছে। ফিনটেক ৩.০, ওপেন ব্যাংকিং, ডিজিটাল ব্যাংক এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) নিয়ে গবেষণা চলছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে ডিজিটাল অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশের জিডিপিতে ডিজিটাল অর্থনীতির অবদান ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যা বর্তমানে ৩ শতাংশের কাছাকাছি।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতি একটি রূপান্তরমূলক পর্যায়ে রয়েছে। সঠিক নীতিমালা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে এই খাতের সম্ভাবনাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগানো সম্ভব, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে।