জলবায়ু পরিবর্তন: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে ঝুঁকি

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১৭ শতাংশ জমি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যেতে পারে, যা প্রায় ২ কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করবে।

লবণাক্ততা বৃদ্ধি: কৃষি ও পানীয় জলের সংকট

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূ-গর্ভস্থ পানিতে মিশে যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা প্রায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণাক্ততার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ধান, সবজি এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া, পানীয় জলের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস: বাড়ছে তীব্রতা ও ঘনত্ব

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় গঠনের প্রবণতা বেড়েছে। গত দশকে বাংলাদেশে সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্ফান, ইয়াস-সহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে বঙ্গোপসাগরের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ানোর অন্যতম কারণ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দশকগুলোতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে, যা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার জন্য মারাত্মক হুমকি।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: ভূমি হারানোর আশঙ্কা

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ৪-৮ মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১১ শতাংশ ভূমি স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাবে। এর ফলে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, যা দেশের জন্য একটি বিশাল মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।

জীববৈচিত্র্য হ্রাস: সুন্দরবনের হুমকি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ বছরে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। এছাড়া, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমির এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীর বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরে সুন্দরবনের একটি বড় অংশ হারিয়ে যেতে পারে।

অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 'বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা' (বিসিসিএসএপি), 'জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড' এবং 'জলবায়ু অভিযোজন ও সহনশীলতা প্রকল্প' (সিএআরপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ-সহিষ্ণু ফসল চাষ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, সোলার ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট স্থাপন, ম্যানগ্রোভ বন সৃজন এবং বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করা হচ্ছে। এছাড়া, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, সতর্কীকরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। বাংলাদেশ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি), প্যারিস চুক্তি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।

তবে, উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর পর্যাপ্ত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রয়োজন প্রতি বছর কমপক্ষে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, যা দেশের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে সম্ভব নয়।

সামগ্রিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা, টেকসই উন্নয়ন কৌশল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। তবে, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করা সম্ভব, যা দেশের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।