বাংলাদেশের গ্রামে ১০০ বছরের বৃদ্ধার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি: ১০০০ লোকগান মুখস্থ
বাংলাদেশের গ্রামে ১০০ বছরের বৃদ্ধার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি: ১০০০ লোকগান মুখস্থ
প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেন ১০০ বছর বয়সী ফাতেমা বেগম, যিনি তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। তিনি ১০০০-এরও বেশি বাংলা লোকগান মুখস্থ রেখেছেন এবং যেকোনো অনুষ্ঠানে বিনা কাগজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান গাইতে পারেন। তার এই অসাধারণ প্রতিভা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে তার অবদানকে আলোকিত করেছে।
শতবর্ষী গায়িকার জীবন
ফাতেমা বেগম ১৯২৫ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক, কিন্তু পারিবারিকভাবে তারা ছিলেন সংগীতপ্রেমী। ফাতেমার মা ও দাদি উভয়েই লোকগান গাইতেন, এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি তাদের কাছ থেকে গান শিখতে শুরু করেন।
"আমার মা খুব সুন্দর গান গাইতেন," ফাতেমা বেগম বলেন। "আমি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনি আমাকে গান শোনাতেন। আমি শুনে শুনে সেগুলো মুখস্থ করে ফেলতাম।"
মাত্র ৭ বছর বয়সে ফাতেমা তার প্রথম জনসম্মুখে গান পরিবেশন করেন একটি গ্রামীণ মেলায়। সেই সময় থেকেই তার গানের প্রতি অনুরাগ বাড়তে থাকে। তিনি কখনও স্কুলে যাননি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীত শিক্ষাও পাননি, কিন্তু তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও সংগীতের প্রতি ভালোবাসা তাকে একজন অসামান্য গায়িকা হিসেবে গড়ে তুলেছে।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি
ফাতেমা বেগমের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। তিনি ১০০০-এরও বেশি লোকগান মুখস্থ রেখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া-সহ বিভিন্ন ধরনের গান। এছাড়া, তিনি বিভিন্ন ঋতু, উৎসব, বিয়ে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কিত গানও জানেন।
"আমি একবার কোনো গান শুনলে আর ভুলি না," তিনি বলেন। "আমার মনে হয় গানগুলো আমার রক্তে মিশে আছে। আমি যখন গাই, তখন সেগুলো আপনা-আপনি বেরিয়ে আসে।"
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাতেমা বেগমের এই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি একটি বিরল নিউরোলজিকাল অবস্থা 'হাইপারথাইমেসিয়া' হতে পারে, যেখানে ব্যক্তি অসাধারণ বিস্তারিতভাবে দীর্ঘকালীন স্মৃতি ধরে রাখতে পারেন। এটি বিশ্বব্যাপী মাত্র কয়েকজন মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়।
ভাইরাল হওয়ার গল্প
ফাতেমা বেগমের গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় যখন তার নাতি, আবদুল হামিদ, তার দাদির একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ১০০ বছর বয়সী ফাতেমা বেগম একটানা ৪৫ মিনিট ধরে বিভিন্ন লোকগান গাইছেন, একটিও ভুল না করে।
ভিডিওটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং লাখ লাখ ভিউ পায়। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র তার সাক্ষাৎকার নেয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) তার উপর একটি বিশেষ ডকুমেন্টারি তৈরি করে, যা জাতীয় পর্যায়ে প্রচারিত হয়।
"আমি কখনও ভাবিনি আমার দাদির গান এত মানুষ শুনবে," আবদুল হামিদ বলেন। "আমি শুধু চেয়েছিলাম যেন লোকেরা আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে। আমার দাদি এই ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সংগ্রহশালা।"
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ
ফাতেমা বেগমের ভাইরাল হওয়ার পর, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে তার সমস্ত গান রেকর্ড করা হচ্ছে এবং একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা হচ্ছে।
"ফাতেমা বেগম আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ," বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিমন মোল্লা বলেন। "তার মুখস্থ থাকা অনেক গান এমন, যা আর কেউ জানে না। এগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগে আমরা সেগুলো সংরক্ষণ করতে চাই।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংগীত বিভাগের গবেষকরা ফাতেমা বেগমের গান নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা ইতোমধ্যে ৫০০-এরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন এবং সেগুলোর সুর, তাল, ভাষা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করছেন।
জীবনের শেষ প্রান্তে স্বীকৃতি
১০০ বছর বয়সে, ফাতেমা বেগম এখন শারীরিকভাবে দুর্বল, কিন্তু তার কণ্ঠ এবং স্মৃতিশক্তি এখনও অটুট আছে। তিনি এখন তার নাতি-নাতনিদের সাথে থাকেন, যারা তার যত্ন নেয়। তার জীবনের শেষ প্রান্তে পাওয়া এই স্বীকৃতি তাকে অত্যন্ত আনন্দিত করেছে।
"আমি কখনও ভাবিনি আমার গান এত মানুষ শুনবে," তিনি বলেন। "আমি গান গেয়েছি কারণ আমি গান ভালোবাসি। এটা আমার জীবনের অংশ। এখন যদি আমার গান অন্যদের আনন্দ দেয়, তাহলে আমি ধন্য।"
২০২৪ সালে, বাংলাদেশ সরকার তাকে 'একুশে পদক' প্রদান করে, যা দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি, তাই রাষ্ট্রপতি নিজেই তার গ্রামে গিয়ে তাকে পদক প্রদান করেন - যা এক বিরল সম্মান।
নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা
ফাতেমা বেগমের গল্প বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে লোকসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে লোকসংগীত শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। অনেক তরুণ শিল্পী তার গান শিখছেন এবং আধুনিক ব্যাখ্যায় সেগুলো পরিবেশন করছেন।
ফাতেমা বেগমের নাতনি, নাজমা আক্তার, একজন সংগীত শিক্ষিকা হয়েছেন এবং তার দাদির গান নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। "আমার দাদি আমাদের শিখিয়েছেন যে, সংগীত শুধু মনোরঞ্জনের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাহক," তিনি বলেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন "ফাতেমা বেগম লোকসংগীত প্রতিযোগিতা" আয়োজন করা হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিলুপ্তপ্রায় লোকগান পরিবেশন করেন।
সংগীতের শক্তি
ফাতেমা বেগমের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংগীতের অসাধারণ শক্তি সম্পর্কে। তার মতে, সংগীত তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার রহস্য। "আমি প্রতিদিন গান গাই," তিনি বলেন। "গান আমাকে শক্তি দেয়, আমাকে সুস্থ রাখে।"
চিকিৎসা বিজ্ঞানও এই দাবিকে সমর্থন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত গান গাওয়া মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে এবং ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স রোগের ঝুঁকি কমায়।
ফাতেমা বেগমের নিউরোলজিস্ট ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, "তার মস্তিষ্কের সক্রিয়তা একজন ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তির মতো। আমরা বিশ্বাস করি, নিয়মিত গান গাওয়া তার মস্তিষ্ককে সক্রিয় রেখেছে এবং তার স্মৃতিশক্তি সংরক্ষণে সাহায্য করেছে।"
একটি জীবন্ত ঐতিহ্য
ফাতেমা বেগম আজ বাংলাদেশের একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। তার গান শুধু সুরের সমাহার নয়, বরং একটি যুগের, একটি সংস্কৃতির, একটি জীবনধারার প্রতিফলন। তার মাধ্যমে আমরা বাংলার লোকসংগীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারি, যা অন্যথায় হারিয়ে যেত।
"আমি চাই আমার গান যেন আমার মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকে," ফাতেমা বেগম বলেন। "এই গানগুলো আমার নয়, এগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের। আমি শুধু এগুলো সংরক্ষণ করেছি। এখন আমি চাই নতুন প্রজন্ম এগুলো শিখুক এবং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করুক।"
ফাতেমা বেগমের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিভা ও জ্ঞান কোনো বয়স, শিক্ষা বা সামাজিক অবস্থান দেখে আসে না। একজন অশিক্ষিত গ্রামীণ মহিলা তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও সংগীতের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারেন - এটি প্রমাণ করে যে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অসাধারণ কিছু লুকিয়ে আছে, যা আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।