বাংলাদেশ রিকশাচালকের অসাধারণ শিল্পকর্ম: রিকশায় আঁকা ছবি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে

বাংলাদেশি রিকশাচালকের অসাধারণ শিল্পকর্ম: রিকশায় আঁকা ছবি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে | TopTending

বাংলাদেশি রিকশাচালকের অসাধারণ শিল্পকর্ম: রিকশায় আঁকা ছবি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের রাজশাহীর একজন সাধারণ রিকশাচালক তার অসাধারণ শিল্পকর্ম দিয়ে বিশ্বজুড়ে নজর কেড়েছেন। ৫৫ বছর বয়সী আবদুল করিম তার রিকশার পিছনে এবং পাশে অসাধারণ চিত্রকর্ম করে থাকেন, যা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক শিল্প সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একজন অশিক্ষিত রিকশাচালক থেকে বিশ্বখ্যাত শিল্পী হয়ে ওঠার এই অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প বাংলাদেশের লোকশিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে।

অসাধারণ প্রতিভার আবিষ্কার

আবদুল করিম রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তিনি মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী শহরে চলে আসেন এবং রিকশা চালানো শুরু করেন। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি এই পেশায় নিয়োজিত আছেন।

করিম সাহেবের শিল্প প্রতিভা প্রথম আবিষ্কার করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম আরা। তিনি প্রায়ই করিমের রিকশায় যাতায়াত করতেন এবং লক্ষ্য করেন যে, তার রিকশার পিছনে অসাধারণ চিত্রকর্ম রয়েছে। একদিন তিনি করিমকে জিজ্ঞাসা করেন, "এই ছবিগুলো কে এঁকেছে?" করিম নম্রভাবে উত্তর দেন, "আমি নিজেই এঁকেছি স্যার।"

ড. শামীম আরা করিমের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন এবং তার ছবির ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। ছবিগুলো দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং হাজার হাজার লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট পায়।

অনন্য শিল্পশৈলী

আবদুল করিমের শিল্পকর্ম বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি, ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং লোকজ সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে। তিনি সাধারণ প্লাস্টিক পেইন্ট ব্যবহার করেন, কিন্তু তার রঙের ব্যবহার এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জীবন্ত।

তার রিকশার পিছনে আঁকা পদ্মা নদীর সূর্যাস্ত, মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ, রাজশাহীর রেশম শিল্প, বাউল গানের আসর - এসব দৃশ্য অসাধারণ বিস্তারিত এবং আবেগপূর্ণ। বিশেষ করে, তার আঁকা মানুষের মুখের অভিব্যক্তি এবং প্রকৃতির সূক্ষ্ম বিবরণ শিল্প সমালোচকদের বিস্মিত করেছে।

"আমি কখনও কোনো শিল্প প্রশিক্ষণ পাইনি," করিম বলেন। "ছোটবেলায় আমি মাটিতে কাঠি দিয়ে ছবি আঁকতাম। পরে, যখন রিকশা চালাতে শুরু করলাম, আমি দেখলাম অন্যান্য রিকশায় নানা ছবি আঁকা আছে। আমিও আমার রিকশায় ছবি আঁকতে শুরু করলাম।"

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

করিমের শিল্পকর্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তার গল্প প্রকাশ করে। বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা - সবাই তার সাক্ষাৎকার নেয় এবং তার শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তার রিকশা ও শিল্পকর্মের একটি বিশেষ ফটো ফিচার প্রকাশ করে।

২০২৪ সালের শেষদিকে, লন্ডনের প্রখ্যাত সাচি গ্যালারি করিমকে তাদের "আনডিসকভার্ড আর্টিস্টস" সিরিজে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তার ১০টি শিল্পকর্ম (রিকশার পিছনের প্যানেল) লন্ডনে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে ব্যাপক প্রশংসা পায়। এর মধ্যে একটি শিল্পকর্ম ৫,০০০ পাউন্ডে বিক্রি হয়, যা তার জীবনে সবচেয়ে বড় অর্থের অঙ্ক।

এরপর, নিউইয়র্ক, টোকিও, প্যারিস এবং সিডনিতে তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। বিশ্বখ্যাত শিল্প সমালোচক রবার্ট হিউজ তার শিল্পকর্মকে "অকৃত্রিম, শক্তিশালী এবং অত্যন্ত আবেগপূর্ণ" বলে বর্ণনা করেন।

জীবনের পরিবর্তন

আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনের পর করিমের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তিনি এখন আর প্রতিদিন রিকশা চালান না, বরং তার শিল্পকর্মের জন্য একটি ছোট স্টুডিও স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি ও সংগ্রাহকরা তার কাজ কিনতে আগ্রহী, যা তাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে।

"আমি কখনও ভাবিনি আমার আঁকা ছবি এত দূর যাবে," করিম বলেন। "আমি শুধু আনন্দের জন্য আঁকতাম। এখন লোকেরা আমার ছবি দেখতে আসে, আমার সাথে ছবি তোলে। এটা আমার জন্য একটা স্বপ্নের মতো।"

করিম তার আয় দিয়ে তার গ্রামের বাড়ি পুনর্নির্মাণ করেছেন এবং তার দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিয়েছেন। তার বড় ছেলে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে পড়াশোনা করছে - পিতার পথ অনুসরণ করে।

শিল্পকলার প্রতি ভালোবাসা

সাফল্য ও খ্যাতি সত্ত্বেও করিম তার সহজ-সরল জীবনযাপন ছাড়েননি। তিনি এখনও মাঝে মাঝে রিকশা চালান, বিশেষ করে যখন তার শিল্পকর্মের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা দরকার হয়।

"রিকশা চালানোর সময় আমি বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করি, বিভিন্ন দৃশ্য দেখি। এগুলো আমার ছবির জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়," তিনি বলেন। "আমি রিকশা চালানো ছাড়তে চাই না, কারণ এটাই আমাকে শিল্পী হতে সাহায্য করেছে।"

করিম প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ছবি আঁকেন। তার মতে, এটি তার দিনকে সুন্দর করে তোলে। তিনি এখন তার শিল্পকলা শেখাতেও শুরু করেছেন - রাজশাহীর বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিশুদের ছবি আঁকা শেখান।

"আমি চাই যেন সবাই ছবি আঁকতে শিখে," তিনি বলেন। "এটা মনকে শান্তি দেয়, জীবনকে সুন্দর করে তোলে।"

বাংলাদেশের লোকশিল্পের নতুন দিগন্ত

আবদুল করিমের সাফল্য বাংলাদেশের লোকশিল্পের প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। রিকশা আর্ট, যা বাংলাদেশের অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এখন লোকশিল্পীদের সহায়তা ও প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন "রিকশা আর্ট টুর" নামে একটি বিশেষ পর্যটন প্যাকেজ চালু করেছে, যেখানে পর্যটকরা রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিখ্যাত রিকশা শিল্পীদের কাজ দেখতে পারেন এবং তাদের সাথে কথা বলতে পারেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় "লোকশিল্প গবেষণা কেন্দ্র" স্থাপন করেছে, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন লোকশিল্প, বিশেষ করে রিকশা আর্ট নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এখানে করিমের কাজের একটি বিশেষ সংগ্রহশালা স্থাপন করা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

আবদুল করিম এখন ৫৫ বছর বয়সে পৌঁছেও নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। তিনি একটি শিল্প স্কুল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিশুদের বিনামূল্যে শিল্পকলা শেখানো হবে।

"আমি চাই যেন আমার মতো অনেক শিশু, যারা স্কুলে যেতে পারে না, তারাও নিজেদের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পায়," তিনি বলেন। "শিল্পকলা শুধু আনন্দ দেয় না, এটি জীবিকার উপায়ও হতে পারে।"

করিম একটি বই লেখার কাজও করছেন, যেখানে তিনি তার জীবনের গল্প এবং শিল্পকলার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। বইটি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশিত হবে।

আবদুল করিমের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিভা কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামাজিক অবস্থান দেখে আসে না। একজন সাধারণ রিকশাচালক তার ভালোবাসা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বখ্যাত শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন - এটি প্রমাণ করে যে, সত্যিকারের প্রতিভা কোনো বাধাই মানে না।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন
পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
comment url