বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার: সম্ভাবনা ও প্রভাব

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশও এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' থেকে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার লক্ষ্যে এআই একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করছে।

বাংলাদেশে এআই এর বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে 'জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল' প্রণয়ন করেছে, যা দেশে এআই প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহারের জন্য একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করছে। এই কৌশলের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থা এআই-ভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়ন করছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে 'স্টার্টআপ বাংলাদেশ' এবং 'ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিউরশিপ একাডেমি' (আইডিইএ) এআই স্টার্টআপ ও গবেষণাকে উৎসাহিত করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০টি এআই-ভিত্তিক স্টার্টআপ রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন খাতে ইনোভেটিভ সমাধান তৈরি করছে।

শিক্ষা খাতে এআই

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। 'স্মার্ট স্কুল' প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্কুলে এআই-ভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের শেখার ধরন অনুযায়ী পাঠদান পদ্ধতি পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়া, 'শিখো' এবং 'টেন মিনিট স্কুল'-এর মতো এডটেক প্ল্যাটফর্মগুলো এআই ব্যবহার করে পার্সোনালাইজড লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স প্রদান করছে। এসব প্ল্যাটফর্মে ছাত্রছাত্রীদের শেখার গতি ও দক্ষতা বিশ্লেষণ করে তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয়।

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) 'এআই ফর ইউথ' প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এআই প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম এআই প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করছে, যা ভবিষ্যতে দেশে এআই ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

স্বাস্থ্য খাতে এআই

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। 'মায়া আপা' নামক একটি এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট মহিলাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, যা বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করতে সাহায্য করছে।

এছাড়া, 'সেরভিকা' নামক একটি এআই-ভিত্তিক মোবাইল অ্যাপ সার্ভিকাল ক্যান্সার শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীরা এই অ্যাপ ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে সার্ভিকাল ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এআই-ভিত্তিক রেডিওলজি সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যা এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই ইমেজ বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করছে। এর ফলে রোগ নির্ণয়ের সময় ও খরচ উভয়ই কমেছে।

কৃষি খাতে এআই

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ কমাতে সাহায্য করছে। 'স্মার্ট ফার্মিং' প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য এআই-ভিত্তিক পরামর্শ সেবা চালু করা হয়েছে।

এআই-ভিত্তিক মোবাইল অ্যাপ 'কৃষক বন্ধু' কৃষকদের ফসলের রোগ-বালাই শনাক্তকরণ, মাটির উর্বরতা পরিমাপ, জলবায়ু পূর্বাভাস এবং ফসলের মূল্য সম্পর্কে তথ্য প্রদান করছে। এছাড়া, ড্রোন ও স্যাটেলাইট ইমেজিং ব্যবহার করে ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও ফলন পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এআই ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। এর ফলে লবণাক্ততা, খরা এবং বন্যা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হচ্ছে।

শিল্প ও সেবা খাতে এআই

বাংলাদেশের শিল্প ও সেবা খাতেও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পে এআই-ভিত্তিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পণ্যের মান নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া অপ্টিমাইজ করতে সাহায্য করছে।

ব্যাংকিং খাতে এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট, ফ্রড ডিটেকশন সিস্টেম এবং ক্রেডিট স্কোরিং মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে গ্রাহক সেবার মান উন্নত হয়েছে এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হয়েছে।

টেলিকম খাতে এআই ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক অপ্টিমাইজেশন, গ্রাহক সেবা উন্নয়ন এবং নতুন পণ্য ও সেবা উদ্ভাবন করা হচ্ছে। গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক-সহ বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানি এআই-ভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়ন করছে।

সরকারি সেবায় এআই

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সরকারি সেবায় এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। 'সুশাসন' প্রকল্পের মাধ্যমে এআই-ভিত্তিক সিটিজেন ফিডব্যাক সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যা নাগরিকদের অভিযোগ ও পরামর্শ বিশ্লেষণ করে সরকারি সেবার মান উন্নয়নে সাহায্য করছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেসে এআই-ভিত্তিক ফেস রিকগনিশন সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে, যা পরিচয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়াকে আরও নিরাপদ ও দ্রুত করেছে। এছাড়া, ট্যাক্স ফাঁকি শনাক্তকরণ, অপরাধ প্রতিরোধ এবং ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহারে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর দুর্বলতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, ডাটা প্রাইভেসি ও নিরাপত্তা এবং আইনি কাঠামোর অপর্যাপ্ততা প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 'এআই স্কিল ডেভেলপমেন্ট' প্রোগ্রামের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই বিষয়ক কোর্স ও গবেষণা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।

এছাড়া, 'এআই ডাটা প্রোটেকশন আইন' প্রণয়নের কাজ চলছে, যা ডাটা প্রাইভেসি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সরকারের 'স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১' ভিশন অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের সকল খাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশের জিডিপিতে এআই প্রযুক্তির অবদান ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া, এআই খাতে প্রায় ৫ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। সঠিক নীতিমালা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে এই প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে পূর্ণরূপে কাজে লাগানো সম্ভব, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে।