বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি উদ্যোগ: শহরের ভবিষ্যৎ রূপরেখা

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশে দ্রুত শহরায়নের ফলে শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, যানজট, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার স্মার্ট সিটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরগুলোকে আরও বাসযোগ্য, দক্ষ এবং টেকসই করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

স্মার্ট সিটি কনসেপ্ট

স্মার্ট সিটি হলো এমন একটি শহর, যেখানে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি), ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডাটা এনালিটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-সহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরের বিভিন্ন সেবা ও অবকাঠামোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। এর মাধ্যমে পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক টেকসইতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

স্মার্ট সিটির প্রধান উপাদানগুলো হলো: স্মার্ট গভর্নেন্স, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট মোবিলিটি, স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, স্মার্ট লিভিং এবং স্মার্ট পিপল। এসব উপাদান একত্রিত হয়ে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে 'স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১' ভিশন ঘোষণা করেছে, যার অংশ হিসেবে দেশের প্রধান শহরগুলোকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর এবং ময়মনসিংহ - এই আটটি বিভাগীয় শহরে স্মার্ট সিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

এছাড়া, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের 'স্মার্ট গ্রিড' প্রকল্প, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' প্রকল্প এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের 'ডিজিটাল মিউনিসিপ্যালিটি সার্ভিসেস' প্রকল্প স্মার্ট সিটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

ঢাকা স্মার্ট সিটি প্রকল্প

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) যৌথভাবে 'ঢাকা স্মার্ট সিটি' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে:

১. স্মার্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট: ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলোতে স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল, সিসিটিভি ক্যামেরা এবং সেন্সর স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ট্রাফিক মনিটরিং এবং ট্রাফিক সিগন্যাল অপ্টিমাইজেশন করা সম্ভব হচ্ছে, যা যানজট কমাতে সাহায্য করছে।

২. স্মার্ট পার্কিং: শহরের বিভিন্ন স্থানে স্মার্ট পার্কিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যেখানে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পার্কিং স্লট বুক করা, পার্কিং ফি পরিশোধ করা এবং খালি পার্কিং স্পেস সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

৩. স্মার্ট স্ট্রিট লাইটিং: এনার্জি-এফিশিয়েন্ট এলইডি লাইট এবং মোশন সেন্সর ব্যবহার করে স্মার্ট স্ট্রিট লাইটিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে সাহায্য করছে।

৪. স্মার্ট ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট: বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। স্মার্ট ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিগন্যাল পাঠায় যখন তা পূর্ণ হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম স্মার্ট সিটি উদ্যোগ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (সিসিসি) 'স্মার্ট চট্টগ্রাম সিটি' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় স্মার্ট ওয়াটার মিটারিং, স্মার্ট গ্রিড, স্মার্ট বিল্ডিং এবং স্মার্ট সিকিউরিটি সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলছে।

বিশেষ করে, চট্টগ্রাম বন্দরে 'স্মার্ট পোর্ট' উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে ব্লকচেইন টেকনোলজি ব্যবহার করে কার্গো ট্র্যাকিং, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।

অন্যান্য শহরে স্মার্ট সিটি উদ্যোগ

খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর এবং ময়মনসিংহ শহরেও বিভিন্ন স্মার্ট সিটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব শহরে ডিজিটাল সিটি সার্ভিসেস, ই-গভর্নেন্স, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট হেলথকেয়ার এবং স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম চালু করার কাজ চলছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, পাবনা শহরে 'স্মার্ট সোলার সিটি' প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শহরের বিদ্যুৎ চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা হবে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি উদ্যোগ বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, আর্থিক সংকট, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, সাইবার নিরাপত্তা, ডাটা প্রাইভেসি এবং আইনি কাঠামোর দুর্বলতা প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল অনুসরণ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। আইসিটি বিভাগ 'স্মার্ট সিটি একাডেমি' প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে স্মার্ট সিটি প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

এছাড়া, 'স্মার্ট সিটি ডাটা প্রোটেকশন আইন' প্রণয়নের কাজ চলছে, যা ডাটা প্রাইভেসি ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশ সরকারের 'স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১' ভিশন অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের সকল শহরকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

১. ৫জি নেটওয়ার্ক: দেশের সকল শহরে ৫জি নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে, যা স্মার্ট সিটি প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।

২. স্মার্ট গ্রিড: দেশব্যাপী স্মার্ট গ্রিড স্থাপন করা হবে, যা বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য করবে।

৩. স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট: পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যা পানির অপচয় রোধ ও গুণগত মান নিশ্চিত করবে।

৪. স্মার্ট পাবলিক ট্রান্সপোর্ট: ইন্টিগ্রেটেড পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলা হবে, যেখানে বিভিন্ন পরিবহন মাধ্যম একত্রিত হবে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করা যাবে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি উদ্যোগ শহরগুলোকে আরও বাসযোগ্য, দক্ষ এবং টেকসই করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরের সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব, যা শেষ পর্যন্ত নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করবে।