বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের উত্থান: সাফল্যের গল্প ও চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, পারিবারিক বাধা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অসংখ্য নারী ব্যবসা-বাণিজ্যে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন, যা মোট উদ্যোক্তার প্রায় ১০ শতাংশ।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীদের অগ্রগতি

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তারা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। পোশাক ও ফ্যাশন ডিজাইন, হস্তশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বিউটি পার্লার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং ই-কমার্স খাতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে নারী পরিচালিত এসএমই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী।

সাফল্যের গল্প: অনুপ্রেরণার উৎস

বাংলাদেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন যাদের সাফল্যের গল্প অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। বিবিয়ানা পারভীন, যিনি 'বিবিয়ানা ফুডস' নামে একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন, বর্তমানে তার পণ্য দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। তার প্রতিষ্ঠানে ২০০ জনেরও বেশি নারী কর্মরত রয়েছেন।

সামিরা জামান, 'জামান হ্যান্ডিক্রাফ্টস' এর প্রতিষ্ঠাতা, গ্রামীণ নারীদের তৈরি হস্তশিল্প পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে সফলতা অর্জন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৫০০ গ্রামীণ নারী আয়ের সুযোগ পেয়েছেন।

নাজনীন আরা, 'হেরিটেজ ফ্যাশন' এর প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড় ও ফ্যাশন আইটেম নিয়ে কাজ করছেন। তার ব্র্যান্ড বর্তমানে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউস হিসেবে পরিচিত।

টেকনোলজি খাতে নারী উদ্যোক্তা

সম্প্রতি বাংলাদেশে টেকনোলজি খাতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স, ফিনটেক এবং হেলথটেক খাতে অনেক নারী সফলভাবে স্টার্টআপ পরিচালনা করছেন।

আইসিটি বিভাগের 'উইমেন ইন টেক' প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩০০টি টেক স্টার্টআপ রয়েছে যেগুলো নারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত। এসব স্টার্টআপ গত বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে।

আইভি হক, 'প্রিয়োশপ' নামক একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্য অনলাইনে বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছেন। তাসনুভা আহমেদ, 'মেডিকেয়ার' নামক একটি হেলথটেক স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা, অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করেছেন।

চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা

উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তারা এখনও নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। আর্থিক সহায়তা ও ঋণ প্রাপ্তিতে বাধা, সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা, ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কের অভাব, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ঘাটতি এবং বাজার সম্প্রসারণের সীমাবদ্ধতা প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) এর এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন। এছাড়া, ৭০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা মনে করেন, পারিবারিক দায়িত্ব ও ব্যবসার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার 'জয়িতা' প্রকল্পের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ প্রদান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা চালু করেছে, যেখানে সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়।

এছাড়া, বিডব্লিউসিসিআই, উইমেন এন্টারপ্রেনিউর নেটওয়ার্ক (ডব্লিউইএন), উইমেন ইন টেক, শি ভেঞ্চার্স-সহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ, নেটওয়ার্কিং এবং বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ, ই-কমার্সের প্রসার, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা বৃদ্ধির ফলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। বিশেষ করে টেকনোলজি, ই-কমার্স, ফ্যাশন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং হস্তশিল্প খাতে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের উত্থান দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নারী ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে এবং সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে নারী উদ্যোক্তারা আগামী দিনে আরও বেশি সাফল্য অর্জন করবেন বলে আশা করা যায়।