বাংলাদেশ শিক্ষার্থীর তৈরি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক বিকল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর তৈরি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক বিকল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল | TopTending

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর তৈরি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক বিকল্প আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের এক তরুণ শিক্ষার্থী পাটের আঁশ থেকে তৈরি করেছেন প্লাস্টিকের এক অভিনব বিকল্প, যা পরিবেশবান্ধব এবং সম্পূর্ণ জৈব-অপঘটনযোগ্য। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদের এই উদ্ভাবন সম্প্রতি "গ্লোবাল গ্রিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫" জিতেছে এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই

প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় পরিবেশগত সমস্যা। প্রতি বছর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সমুদ্র, নদী ও মাটিতে জমা হয়। সাধারণ প্লাস্টিক পচতে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় নেয়, যা পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে।

বাংলাদেশ ২০০২ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করে বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর একটি হলেও, এখনও দেশে প্লাস্টিক দূষণ একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধানে নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তানভীর আহমেদ।

পাট থেকে প্লাস্টিক: উদ্ভাবনের গল্প

তানভীর আহমেদ খুলনার একটি পাট চাষি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাটের সাথে পরিচিত ছিলেন এবং এর বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে জানতেন। পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সময় তিনি প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারেন এবং এর বিকল্প খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন।

"আমি ভাবতে শুরু করলাম, পাট যদি এত শক্তিশালী ও টেকসই ফাইবার হয়, তাহলে এটি থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করা যাবে কি না," তানভীর বলেন। "আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা শুরু করলাম এবং বিভিন্ন পদ্ধতি পরীক্ষা করতে লাগলাম।"

দুই বছরের গবেষণার পর, ২০২৪ সালে তানভীর সফলতা পান। তিনি পাটের আঁশ, প্রাকৃতিক রেজিন এবং কিছু জৈবিক যৌগ মিশিয়ে একটি উপাদান তৈরি করতে সক্ষম হন, যা দেখতে ও ব্যবহারে প্লাস্টিকের মতো, কিন্তু সম্পূর্ণ জৈব-অপঘটনযোগ্য। এই উপাদান মাত্র ৩-৬ মাসের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পচে যায় এবং মাটির জন্য কোনো ক্ষতিকর নয়।

বিশেষ বৈশিষ্ট্য

তানভীরের তৈরি "জুট-প্লাস্ট" (পাট-প্লাস্টিক) নামক এই উপাদানের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

১. জৈব-অপঘটনযোগ্যতা: সাধারণ প্লাস্টিকের তুলনায় এটি অনেক দ্রুত (৩-৬ মাসে) পচে যায়।

২. শক্তি ও স্থায়িত্ব: এটি সাধারণ প্লাস্টিকের মতোই শক্ত এবং টেকসই, বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।

৩. তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা: এটি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, যা অনেক প্লাস্টিকের চেয়ে বেশি।

৪. পানি প্রতিরোধী: বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়ায় এটি পানি প্রতিরোধী, যা এর ব্যবহারিক মূল্য বাড়ায়।

৫. কম উৎপাদন খরচ: সাধারণ প্লাস্টিকের তুলনায় এর উৎপাদন খরচ প্রায় ২০% কম।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

তানভীরের উদ্ভাবন প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে নজর কাড়ে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ইনোভেশন ফেয়ারে তিনি প্রথম পুরস্কার জিতেন। এরপর বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) তার গবেষণাকে আরও উন্নত করার জন্য অনুদান প্রদান করে।

২০২৫ সালের শুরুতে, তানভীর তার উদ্ভাবন নিয়ে "গ্লোবাল গ্রিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড" প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন, যেখানে বিশ্বের ৬৫টি দেশের ৮০০-এরও বেশি প্রতিযোগী ছিল। মার্চ মাসে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত ফাইনালে তিনি প্রথম পুরস্কার জিতেন, যার মধ্যে রয়েছে ১০০,০০০ ডলার অনুদান এবং তার উদ্ভাবনকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের সুযোগ।

"এটি আমার জন্য একটি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা ছিল," তানভীর বলেন। "আমি কখনও ভাবিনি আমার ছোট্ট গবেষণা এতদূর যাবে। এই স্বীকৃতি আমাকে আরও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।"

বাণিজ্যিক উৎপাদন

পুরস্কার জেতার পর, তানভীর বাংলাদেশে "গ্রিন জুট সলিউশনস" নামে একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে খুলনায় একটি ছোট উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করেছেন, যেখানে জুট-প্লাস্ট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য যেমন - শপিং ব্যাগ, খাবারের প্যাকেজিং, ডিসপোজেবল প্লেট, কাপ ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে।

বিভিন্ন দেশি-বিদেশি কোম্পানি তানভীরের উদ্ভাবনে আগ্রহ দেখিয়েছে। সুইডেনের একটি বড় রিটেইল চেইন ইতোমধ্যে তার কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে তারা তাদের সকল প্লাস্টিক শপিং ব্যাগ জুট-প্লাস্ট দিয়ে প্রতিস্থাপন করবে।

"আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল বাংলাদেশে একটি বড় উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে," তানভীর বলেন। "আমরা চাই বাংলাদেশ থেকে পাটের প্লাস্টিক সারা বিশ্বে রপ্তানি হোক।"

পরিবেশগত প্রভাব

পরিবেশবিদরা তানভীরের উদ্ভাবনকে "গেম-চেঞ্জার" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. নাসরিন আক্তার বলেন, "এই ধরনের উদ্ভাবন প্লাস্টিক দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।"

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি জুট-প্লাস্ট সাধারণ প্লাস্টিকের ১০% প্রতিস্থাপন করতে পারে, তাহলে প্রতি বছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য কম হবে, যা পরিবেশের জন্য একটি বড় অর্জন হবে।

এছাড়া, পাট চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরাও উপকৃত হবেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, জুট-প্লাস্টের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে পাটের চাহিদা কমপক্ষে ৩০% বৃদ্ধি পাবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

তানভীর তার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং জুট-প্লাস্টের আরও উন্নত সংস্করণ তৈরির চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, "আমরা এখন একটি নতুন সংস্করণের উপর কাজ করছি, যা আরও শক্তিশালী হবে এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের কেসিং হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।"

এছাড়া, তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্কশপ পরিচালনা করছেন, যেখানে তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি একটি নন-প্রফিট ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করবে।

"আমার স্বপ্ন হল একটি প্লাস্টিক-মুক্ত বাংলাদেশ দেখা," তানভীর বলেন। "আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশের তরুণরা অনেক সম্ভাবনাময়। আমরা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পাই, তাহলে আমরা বিশ্বের যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারি।"

তানভীর আহমেদের গল্প প্রমাণ করে যে, সীমিত সম্পদ ও সুযোগ সত্ত্বেও, উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা ও অধ্যবসায় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলা সম্ভব। তার উদ্ভাবন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি আশার আলো হিসেবে কাজ করছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন
পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
comment url