সুন্দরবনে দুর্লভ সাদা বাঘের দেখা: বিরল মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের সুন্দরবনে এক দুর্লভ সাদা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলেছে। একজন বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার এই বিরল মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেছেন, যা বিশ্বজুড়ে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও সংরক্ষণবাদীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সাদা বাঘ, যা টাইগ্রিস অ্যালবিনো নামেও পরিচিত, বিশ্বের সবচেয়ে বিরল প্রাণীদের একটি এবং সুন্দরবনে এর অস্তিত্ব নিয়ে এতদিন সন্দেহ ছিল।

বিরল আবিষ্কার

খুলনার একজন বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার আশরাফুল আলম গত সপ্তাহে সুন্দরবনের কটকা এলাকায় বন্যপ্রাণী ছবি তোলার জন্য গিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে, যখন সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ম্যানগ্রোভ বনে ছড়িয়ে পড়ছিল, তিনি একটি অসাধারণ দৃশ্য দেখতে পান - একটি সম্পূর্ণ সাদা বাঘ একটি খালের পাশে পানি পান করছিল।

"আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি আমি কী দেখছি," আশরাফুল বলেন। "আমি ভেবেছিলাম হয়তো আলোর প্রতিফলন, কিন্তু যখন সে ঘুরে তাকাল, আমি দেখলাম এটি সত্যিই একটি সাদা বাঘ - সম্পূর্ণ সাদা লোমে ঢাকা, শুধু নীল চোখ ছাড়া।"

আশরাফুল তার ক্যামেরা দিয়ে দ্রুত ছবি তুলতে শুরু করেন এবং প্রায় ৫ মিনিট ধরে বাঘটিকে দেখতে পান, যতক্ষণ না সেটি বনের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। তিনি মোট ২৩টি ছবি তুলতে সক্ষম হন, যার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বিস্তারিত।

বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া

আশরাফুল যখন তার ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন, তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। বাংলাদেশ বন বিভাগ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা এই ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান বলেন, "এটি একটি অসাধারণ আবিষ্কার। সাদা বাঘ হল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটি জেনেটিক ভেরিয়েন্ট, যেখানে একটি বিরল জেনেটিক মিউটেশনের কারণে মেলানিন পিগমেন্ট উৎপাদন হয় না। বিশ্বে এদের সংখ্যা ২০০-এরও কম বলে মনে করা হয়, এবং সুন্দরবনে এর অস্তিত্ব নিয়ে এতদিন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ ছিল না।"

ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পরিচালক ড. ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, "এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আমরা যতটা জানি তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এটি সংরক্ষণের প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।"

সাদা বাঘের বিরলতা

সাদা বাঘ আসলে অ্যালবিনো নয়, বরং একটি জেনেটিক অবস্থা যাকে লিউসিজম বলা হয়, যেখানে শরীরের লোমে মেলানিন পিগমেন্ট থাকে না, কিন্তু চোখের রঙিন অংশে থাকে। এই কারণে সাদা বাঘের চোখ সাধারণত নীল বা নীলাভ-সবুজ হয়, যেখানে প্রকৃত অ্যালবিনোদের চোখ লাল হয়।

বিশ্বে সাদা বাঘের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বর্তমানে বন্য অবস্থায় মাত্র কয়েকটি সাদা বাঘের অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত তথ্য আছে, যাদের বেশিরভাগই ভারতের রেওয়া এবং বান্ধবগড় জাতীয় উদ্যানে পাওয়া গেছে। চিড়িয়াখানায় আরও কিছু সাদা বাঘ আছে, যাদের বেশিরভাগই ক্যাপটিভ ব্রিডিং প্রোগ্রামের অংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাদা বাঘের এই জেনেটিক বৈশিষ্ট্য রিসেসিভ, অর্থাৎ একটি বাচ্চা সাদা হওয়ার জন্য উভয় পিতামাতার কাছ থেকে এই জিন পেতে হবে। এই কারণে এদের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১০,০০০-এ ১।

সংরক্ষণের গুরুত্ব

সুন্দরবনে সাদা বাঘের আবিষ্কার এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ বন বিভাগ ইতোমধ্যে এই এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে এবং বিশেষ পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করেছে।

বন বিভাগের প্রধান সংরক্ষক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, "আমরা এই সাদা বাঘের সুরক্ষার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ সম্পর্কে আরও জানতে আমরা বিশেষজ্ঞদের সাথে কাজ করছি। এটি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।"

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) এই আবিষ্কারকে "অসাধারণ" বলে বর্ণনা করেছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে সুন্দরবন সংরক্ষণের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে।

পর্যটন ও সচেতনতা

সাদা বাঘের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে সুন্দরবনে পর্যটকদের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই এই বিরল প্রাণীটিকে দেখার আশায় সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন।

তবে বন বিভাগ সতর্কতা অবলম্বন করেছে। "আমরা পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণে স্বাগত জানাই, কিন্তু তাদের অবশ্যই নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হবে," বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন। "অতিরিক্ত মানব উপস্থিতি বন্যপ্রাণীদের জন্য হুমকি হতে পারে, বিশেষ করে এই বিরল সাদা বাঘের জন্য।"

এই ঘটনা সুন্দরবন সংরক্ষণের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করেছে। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে শিক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে।

ফটোগ্রাফারের স্বীকৃতি

আশরাফুল আলম, যিনি এই ঐতিহাসিক ছবি তুলেছেন, এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফি সংস্থা তাকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তার ছবি প্রকাশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।

"আমি কখনও ভাবিনি আমার ছবি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে," আশরাফুল বলেন। "আমি শুধু সুন্দরবনের সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এই বিরল মুহূর্ত ক্যাপচার করতে পেরে আমি ধন্য। আমি আশা করি এটি সুন্দরবন সংরক্ষণে সাহায্য করবে।"

সাদা বাঘের এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃতি এখনও অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। সুন্দরবনের মতো অনন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করা শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের দায়িত্ব। এই সাদা বাঘ হয়তো আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিতে এসেছে।